শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলাজুড়ে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। জেলা শহরসহ ছয় উপজেলায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং শিল্পকারখানায় বন্যার ক্ষতি প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। পুরো জেলা মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে সদরে ও তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে দাগনভূঞাতে।
দোকান মালিক, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার সবচেয়ে বড় পাইকারি পণ্যের বাজার বড় বাজারে সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। শহরে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া বন্যায় শিল্প-কারখানায় ২০০ কোটি টাকা, জেলার পাঁচ উপজেলায় ব্যবসায়ীদের ৫০ কোটি টাকা ও মুদ্রণ-কাগজ ব্যবসায়ীদের ৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে।
ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মুশফিকুর রহমান পিপুল বলেন, বন্যার আঘাত দীর্ঘদিন ভোগাবে বড় বাজারের ব্যবসায়ীদের। ক্ষতির সঙ্গে এখন ঋণের চাপ যোগ হয়েছে।
শহরে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা
ফেনী পৌর এলাকায় আনুমানিক ২০ হাজার দোকানপাট, গুদামঘর ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্তের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা।
ব্যবসাকেন্দ্র বিবেচনায় বড়বাজার ফেনীর প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, এবারের বন্যায় এখানে চাল, ডাল, চিনি, মসলা ও নিত্যপণ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফেনী বাজারের তাকিয়া রোড এবং ইসলামপুর রোডে সর্বাধিক চালের আড়ত রয়েছে। বন্যায় দুইটি সড়ক ও আশপাশের এলাকায় ৫ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়।
চাল আড়তদারদের দাবি, বাজারে ৬৪ জন চালের আড়তদার রয়েছেন। বন্যায় প্রায় ২৫ হাজার টন চাল নষ্ট হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১৫০ কোটি টাকা।
এবারের বন্যায় চিনির বাজারে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীরা একইসঙ্গে আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ নানাবিধ পণ্য বিক্রি করে থাকেন। বড় বাজারের এসব আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের আনুমানিক ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করছেন তারা।
জানা গেছে, ফেনীতে চিনির ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ক্রয় করেন ১০টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে গড়ে ৭৮০ টন চিনি জেলায় সরবরাহ করেন। প্রতি টন চিনির পাইকারি দর ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সাধারণত গড়ে ৬০ টন চিনি বাজারে বিক্রির জন্য মজুদ রাখা হয় ।
শহরের তাকিয়া রোডের আরিফ ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক বলেন, দোকানে রাখা সাড়ে ৫০০ বস্তা চিনি, ১৫০ বস্তা আটা-ময়দা ও ৭০ বস্তা খইল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে টাকা অঙ্কে ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি গুণতে হয়েছে। একই সড়কের চৌধুরী ট্রেডার্সে ৫০০ বস্তা চিনি, ৪০০ বস্তা ভূষি, ১ হাজার বস্তা আটা ও ময়দা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। জাফর এন্টারপ্রাইজে ৯০০ বস্তা আটা-ময়দা ও ৩০০ বস্তা চিনি পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে।
পাইকারি বাজারে চিনি বস্তাপ্রতি ৬ হাজার ২০০ টাকা, আটা-ময়দা গড়ে ২ হাজার টাকা, ভূষি ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে উল্লেখিত ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে।
এদিকে বাজারে ১৩ জন আড়তদার আলু, পেঁয়াজ, আদার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে। বন্যায় প্রায় ১৫০ টন আলু, ১২০ টন পেঁয়াজ, ৭০ টন রসুন, ২৫ টন আদা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব পণ্যের আড়তগুলোর মধ্যে হাজী ইদ্রিস অ্যান্ড সন্স, আল্লাহর দান, রাজু এন্টারপ্রাইজ, হাজী জালাল, আয়েশা ট্রেডার্স, ভক্তি রঞ্জন সাহা, হরিপদ সাহা, ফৌজিয়া ট্রেডার্স ও মদিনা ট্রেডার্স অন্যতম।
এছাড়া ফেনী শহরে নিত্যপণ্য, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
একইভাবে চালের আড়ত, মুড়ির আড়ত, জামান রোড, দর্জিপট্টি, খাজা আহম্মদ সড়ক, বড় মসজিদ গলিসহ বাজারের নিচতলার প্রায় সবগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মুশফিকুর রহমান পিপুল বলেন, কেবল বাজারকে কেন্দ্র করেই বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
ফেনী শহরের উত্তর অংশের ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ইকবাল আলম বলেন, বন্যায় এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ডিসি অফিস, সালাহউদ্দিন মোড়ে ব্যবসায়ীদের ৫০ লাখ টাকা, পৌর হকার্স মার্কেটে ৫০ লাখ টাকা, ফেনী সেন্টারের ব্যবসায়ীদের ৩০ লাখ টাকা, ফেনী গার্ডেন সিটিতে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, স্টেশন রোডে ৫০ লাখ টাকা, মিজান রোডে ৩০ লাখ, আলিয়া মাদরাসা মার্কেটে ২০ লাখ টাকা, মৌলভীবাজার সহদেবপুরে ৫০ লাখ, পোস্ট অফিস রোডে ৫০ লাখ টাকা, গুদাম কোয়ার্টারসহ তেলের মিলে ২ কোটি টাকা, একাডেমি ও হাসপাতাল মোড় এলাকায় ১ কোটি, কদলগাজী রোডে ৫০ লাখ, কলেজ রোড ও আপ্যায়ন আফরোজ টাওয়ারে ৭০ লাখ, মজিদ মিয়ার বাজারে ২০ লাখ এবং এসব এলাকার পাড়া-মহল্লায় ব্যবসায়ীদের অন্তত ১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের পূর্বাংশের ব্যবসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, এ অংশে ব্যবসায়ীদের ১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।