বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণের মাধ্যম হচ্ছে সরকার ঘোষিত পে-স্কেল। দেশে এ পর্যন্ত আটটি পে-স্কল ঘোষিত হয়েছে, যার প্রথমটি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে এবং সর্বশেষটি হয়েছে ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালে ঘোষিত পে-স্কেলটি ছিল অনেক দিক থেকে ভিন্ন। কেননা, অতীতের তুলনায় এ স্কেলে বেতন বৃদ্ধির হার বেশি ছিল এবং পে-কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছিল। আগের কাঠামো ভেঙে ২০টি ধাপে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় এবং বেতন বৃদ্ধির হারও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। অনেক দেশে পে-কমিশন থাকে, যারা সবকিছু বিবেচনা করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।
তখন বলা হয়েছিল পে-কমিশন তৈরি করে পাঁচ বছর পরপর নতুন বেতন স্কেল দেওয়া হবে, যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। ২০১৫ সাল থেকে প্রায় ৯ বছর অতিবাহিত হলেও পে-কমিশন তো দূরের কথা, নতুন পে-স্কেলই হয়নি। যদিও সবাই প্রত্যাশায় ছিলেন যে ২০২০-২১ সালে নতুন পে-স্কেল পাওয়া যাবে কিন্তু আজও আমাদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে। সর্বশেষ বাজেটের সময়ও আমরা আশা করেছিলাম কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এর ফলে সরকারি চাকুরেদের মনে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে এবং এর কারণও অনুমেয়। বর্তমান সরকার অনেক দিক থেকেই ভিন্ন, তারা বৈষম্য নিরসনে কাজ করছেন বলে প্রত্যাশা নিয়ে এ লেখা।
২০১৫ সালের পে-স্কেলে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির একটি সহজ ও সরল সূত্রও দেওয়া ছিল। ২০টি ধাপের জন্য মূল বেতনের সর্বোচ্চ ৫% বৃদ্ধির সুযোগ আছে। সাধারণত ১১-২০তম ধাপে ৫% বৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও ১-১০ম ধাপে সেটা ৩-৪%-এ সীমাবদ্ধ। যদিও মূল বেতন বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যান্য সুবিধাও বৃদ্ধি পায় কিন্তু সেটা যে বিশাল কিছু নয়, গড়ে হয়তো ১-৫ হাজার টাকা বৃদ্ধি পায়। অথচ একই সময়ে দৈনন্দিন জীবনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি। কোনো কোনো জরিপের তথ্যমতে, মানুষের আয় বৃদ্ধির হার ৪-৬%, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০% বা এর চেয়ে বেশি। এটা একটা বেসরকারি তথ্য, কিন্তু সার্বিকভাবে যদি অনুসন্ধান করা হয় তাহলে প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন হবে বলে মনে হয় না।
বর্তমানে বাজারের যে পরিস্থিতি তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রতিনিয়ত নতুন রেকর্ড তৈরি করছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য বাজার এখন যেন আতঙ্কের নাম, তাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এটা শুধু বর্তমান বাজারের জন্যই নয়, বরং কয়েক বছর ধরে আমাদের এভাবেই নাকাল হতে হচ্ছে। সীমিত ও বেতনভুক্ত মানুষের জন্য বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আয় দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে কিংবা অনেকের জন্য এর চেয়ে বেশি। এমন বেহাল বাজার যে শুধু করোনাভাইরাস বা বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য, তা নয়। বরং ২০১৫ সালের পর থেকে পণ্যমূল্য ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। প্রতিবছরই জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে এবং সেটা অনেক ক্ষেত্রে জ্যামিতিক হারে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর তথ্যমতে, ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮.৪৪ শতাংশ ও পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৭.১৭ শতাংশ। অনুরূপভাবে ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ এবং পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫.১৯ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে ২০১৯ সালে, ৬.৫০ শতাংশ ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬.৯২ শতাংশ এবং ২০২২ সালে বেড়েছে ১০.০৮ শতাংশ বেড়েছে। শুধু ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার ৩.১৬ শতাংশ।
করোনাভাইরাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে আজ আমাদের বাজার ব্যবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। করোনাভাইরাসের অজুহাতে দাম বৃদ্ধি হলেও পরে আর কমেনি, বরং নানান অজুহাতে ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএওর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন হয়েছে। এই সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে; যা গত ১২ বছরের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সর্বোচ্চ রেকর্ড।
নিত্যপণ্যের সাথে সাথে বেড়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, মোবাইল খরচ, বাসা ভাড়াসহ প্রায় সবকিছুর। পিঁয়াজ, মসলাসহ অন্যান্য পণ্যের দাম তো কখনও মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। এর সাথে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি হয়েছে; গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। কোনো কিছুই যেন আমাদের নাগালের মধ্যে নেই। যদি বিগত ৫-৬ বছরের কথা বিবেচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫০%। এর সাথে বাড়ছে অন্যান্য সেবার মূল্য। কিন্তু ঐ একই সময়ে বেতন বেড়েছে ২৫-৩০%। এখানে এসে পাটিগণিতের সরল অঙ্কের উত্তর আর মিলছে না।
পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফায় ভারসাম্য রাখেন, চিকিৎসকরা ভিজিট বাড়ান, এমনকি রিকশাওয়ালাও ভাড়া বাড়ান। একইভাবে অন্যান্য ব্যবসায়ী ও সেবাদাতারাও আনুপাতিক হারে মূল্য বৃদ্ধি করেন। এমনকি দৈনিক পত্রিকার দামও ২ টাকা বেড়েছে। কিন্তু বাজারের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আমাদের মতো বেতনভোগীর বেতন স্থির থাকে, থাকে না বিকল্প কোনো সৎ ও হালাল উপায়। অতীতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এখন সেটাও নেই। তাহলে সরকারি বেতনভোগীদের অবস্থা কী হচ্ছে, তা সহজে অনুমেয়। সবাই যখন কোনো না কোনোভাবে নিজেদের মুনাফায় ভারসাম্য রাখছে, তখন সরকারি বেতনভোগীদের বাধ্য হয়ে খরচ কমাতে হচ্ছে বা সঞ্চয় ভেঙে কোনোভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
যদিও সরকারকে এখন কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করি। আমরাও তো দেশের অংশ, নাগরিক এবং অন্যদের মতো আমরাও বাড়তি খরচের চাপে নাকাল হচ্ছি। আমরা দেখেছি প্রজাতন্ত্রের নির্দিষ্ট শ্রেণির সেবকদের জন্য সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করে দামি গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে, কিন্তু বেশির ভাগ সেবক থেকেছেন সুবিধার বাইরে; যাদের কাছে বেতনই প্রধান অবলম্বন। তাই প্রত্যাশা করি, সরকার স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেবে এবং নবম পে-স্কেল ঘোষণা করবে। এটা প্রত্যাশা যে পে-কমিশন গঠন করলে সেটা যেন হয় শিক্ষকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ নিয়ে, কেবল নির্দিষ্ট পেশার মানুষ দিয়ে নয়। এ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, তাই নতুন পে-স্কেল তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বাজারের অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।