বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এই আইনের ১০টি ধারায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার অব্যাহত থাকবে। আইনের বাতিল না হলেও, সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর মামলা বিচারাধীন থাকবে, এমনটাই জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন করা হয়েছে। লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ উপদেষ্টা পরিষদ-বৈঠকের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ পুনরায় উপস্থাপন করবে। সাইবারস্পেসে সেফটি ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করার বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সাচিবিক ও কারিগরি সহায়তায় একটি পৃথক আইনি কাঠামো আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা পরিষদ- বৈঠকে উপস্থাপন করবে।
আইন বাতিল হলে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ‘বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা’ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। তবে, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হলেও, এর অধীনে দায়ের হওয়া কিছু মামলা চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ২৭, ৩০, ৩২ এবং ৩৫ ধারাগুলোর অধীনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার চলবে।
আইনটির মোট ২১টি ধারা ছিল। এর মধ্যে ১০টি ধারা বাতিলের পর, অন্য ১১টি ধারার মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। তবে, ওই ১০টি ধারার অধীনে দায়ের হওয়া মামলার বিচার আগের মতোই চলবে এবং সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে এসব মামলা বিচারাধীন থাকবে।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি সরকার পূর্বে কোনো মামলা প্রত্যাহার না করে থাকে, তবে ওই মামলার বিচার আইনটি বাতিল না হওয়ার শর্তে হবে। ১০টি ধারার অধীনে দায়ের হওয়া মামলার চার্জশিট যদি দাখিল করা হয়ে থাকে বা মামলাটি তদন্তাধীন থাকে, তবে সেগুলোও বিচারাধীন মামলা হিসেবে গণ্য হবে।
এদিকে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় তৈরি করা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)। এই আইনে ৫৭ ধারা বাতিল করার পর বেশ কিছু সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন চালু করা হয়েছিল। বিশেষত বিরোধীমত দমন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়েছিল, যা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) গত ২ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ করেন রাজনীতিকেরা। অভিযোগকারীদের ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশই রাজনীতিক।
২০২৩ সালের ৫ জুন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছিল। এর পরবর্তী সময়ে আরো বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হয়, যা সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে চলে যায়।
সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হলেও ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ২৭, ৩০, ৩২ এবং ৩৫ ধারা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৭ ধারা অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ করলে তিন বছর কারাদণ্ড, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। আর এসব পরিকাঠামোতে প্রবেশ করে ক্ষতি করলে ছয় বছর কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।
১৮ ধারা অনুযায়ী কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশ, প্রবেশে সহযোগিতা, ক্ষতিসাধন বা সুরক্ষিত এসব সিস্টেমে প্রবেশ করলে বা প্রবেশে সহায়তার জন্য সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে।
১৯ ধারায় কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক থেকে কোনো উপাত্ত, উপাত্ত-ভান্ডার, তথ্য বা তার উদ্ধৃতাংশ সংগ্রহ বা স্থানান্তরযোগ্য জমাকৃত তথ্য-উপাত্তসহ উক্ত কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ, ক্ষতিসাধন করলে সাত বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হবে।
২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাস অপরাধের জন্য ১৪ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৩০ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক, বিমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধভাবে ই-ট্রানজেকশন (লেনদেন) করলে ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া যাবে।
৩২ ধারায় হ্যাকিং-সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ১৪ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড রাখা হয়েছে। আর ৩৫ ধারায় কোনো কোম্পানি অপরাধ করলে অর্থদণ্ড দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
বাতিল হবে বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলা: সাইবার নিরাপত্তা আইনের ‘২১ নম্বর ধারা’ বাতিলের প্রস্তাব করার কারণে এই ধারার অধীনে দায়ের হওয়া সব মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। ওই ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ও কুৎসামূলক প্রচারণার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার জন্য ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড হতে পারতো।
এছাড়া ‘২৮ নম্বর ধারা’ বাতিলের প্রস্তাবও করা হয়নি, ফলে ওই ধারার অধীনে ওয়েবসাইটে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোও বাতিল হয়ে যাবে। এসব অপরাধের জন্য ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারতো।